শহর ও গ্রাম এই দুটি ব্যাতিক্রমধর্মী ধারনা সৃষ্টির আগে সমস্ত পৃথিবীই ছিল মূলত বন-জঙ্গল, নদী-নালা ও পাহাড়-পর্বতের সমষ্টি। আর সেখান থেকেই মানুষ বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতো। ধীরে ধীরে তারা বসবাসের জন্য ছোট ছোট কুড়েঘর নির্মান করে। আর সেই কুড়েঘরকে কেন্দ্র করেই তার আশেপাশের জমিতে ফসলের চাষাবাদ শুরু করে। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিকতার সাথে সাথে যে বিশাল শহুরে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সেখানে বসবাসের জন্য বিল্ডিং এবং ব্যবসা-বানিজ্যের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ভবন ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই এই বিশাল শহুরে জনগোষ্ঠীর অক্সিজেনের ঘাটতি পূরন, খাদ্য চাহিদা পূরন এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাটিবিহীন চাষাবাদ, হাইড্রোপনিক্স হতে পারে এক বিশাল সম্ভাবনা। হাইড্রোপনিক্স হলো মাটি ছাড়া পানিতে ফসল (বিশেষ করে সবজি) উৎপাদনের আধুনিক পদ্ধতি। হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা যায়।
চিত্র: ভার্টিক্যাল হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে সবজি চাষ।
ভার্টিক্যাল হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের সুবিধা
১. একই জায়গায় অধিক সংখ্যক গাছ রোপন করা যায়। অর্থাৎ প্রতি একক পরিমান স্থানে ৩-৮ গুন বেশী গাছ লাগানো যায়।
২. এই পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না, পাশাপাশি অনাবাদি জমিকে চাষের আয়তায় আনা সম্ভব।
৩. আলাদাভাবে সার ও সেঁচ প্রয়োগের দরকার হয় না।
৪. মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি হওয়ায় গাছে মাটিবাহিত কিংবা কৃমিজনিত রোগ হয় না বিধায় কীটপতঙ্গের আক্রমন অনেক কম এবং কীটনাশক লাগে না।
৫. গ্রীনহাউজে সারা বছর কিংবা অমৌসুমেও এ পদ্ধতিতে বিষমুক্ত, সতেজ সবজি, ফল ও ফুল চাষাবাদ করা সম্ভব।
৬. প্রাকৃতিক দূর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি ও বন্যায় যখন মাঠে ফসল চাষাবাদ অসম্ভব তখনও হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা সম্ভব।
৭. অন্য যে কোন হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতির চেয়ে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
হাইড্রোপনিক চাষাবাদ পদ্ধতি
সাধারণত দুইটি উপায়ে হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা যায়ঃ
(ক) সঞ্চালন পদ্ধতি
(খ) সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি
চিত্র: সঞ্চালন পদ্ধতি
চিত্র: সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি
সঞ্চালন পদ্ধতিতে, গাছের অত্যাবশকীয় খাদ্য উপাদান সমূহ যথাযথ মাত্রায় পানিতে মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপ এর মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ নিদিষ্ট সময় পরপর সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন অন্ততঃপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার।
সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে, একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে খাদ্য উপাদান সরবাহের জন্য কোন পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবন ও উহার উপর স্থাপিত কর্কশীটের মাঝে ২-৩ ইঞ্চি পরিমান জায়গা ফাঁকা রাখতে হয় অথবা কর্কশীটের উপরে ৪-৫ টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কর্কশীটের ফাঁকা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারে। ফসলের প্রকার ভেদে সাধারনত ২-৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়।
ভার্টিক্যাল হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে উৎপাদনযোগ্য সবজি
পাতা সবজিঃ লেটুস, গীমাকলমি, বিলাতি ধনিয়া, বাঁধাকপি, পুদিনা, লাল শাক, বেসিল।
ফল সবজিঃ টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি, ব্রকলি, মিষ্টি আলু।
লতানো সবজিঃ করলা, শসা, ক্ষিরা, মেলন, লাউ ইত্যাদি।
হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে EC ও pH মিটার এর ব্যবহার
EC হলো একটি নিউট্রিয়েন্ট সলিউসনের সকল খাদ্যোপাদানের মোট ঘনত্ব যা একটি বহনযোগ্য মিটার দিয়ে সহজে মাপা যায়। একটি ঘন দ্রবণের ঊঈ দূর্বল দ্রবণের চেয়ে বেশি হয়। সাধারনত ডেসিসিমেন/মিটার অথবা সমতুল্য মিলিসিমেনস/সেমি এককে EC পরিমাপ করা হয়। EC এর মাত্রা ১.৫-২.৫ ডেসিসিমেন/মিটার এর মধ্যে রাখতে হবে। EC মান বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক দ্রবণ যোগ করতে হয়।
চিত্র: নিউট্রিয়েন্ট সলিউসন এর মান নিয়ন্ত্রনে EC মিটার ও pH মিটার।
pH মান কোন নিউট্রিয়েন্ট সলিউসনের অম্লতা বা ক্ষারীয়তা প্রকাশ করে যা সহজে বহনযোগ্য মিটার দিয়ে পরিমাপ করা যায়। হাইড্রোপনিক্স দ্রবণের pH সাধারনত ৫.৫-৬.৫ হতে হয়। তবে গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে pH মানের পরিবর্তন হয়। পাতাজাতীয় সবজির ক্ষেত্রে pH মানের বৃদ্ধি হয় কারন এসব উদ্ভিদ প্রচুর পরিমানে NO3– গ্রহণ করে। তবে বিভিন্ন সবজিতে EC ও pH এর চাহিদার মাত্রা ভিন্ন হয়।
হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানের পরিমান
হাইড্রোপনিক্স নিউট্রিয়েন্ট সলিউসন তৈরিতে প্রতি ১০০০ লিঃ পানির জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদানের পরিমান:
Stock Solution A
ক্যালসিয়াম নাইট্রেট(১০০০ গ্রাম)
ইডিটিএ আয়রন (৮০ গ্রাম)
(উপরে উল্লেখিত রাসায়নিক দ্রব্য গুলিকে ১০ লিটার পানিতে দ্রবীভুত করে Stock Solution A তৈরী করতে হবে)
Stock Solution B
পটাশিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট(২৭০ গ্রাম)
পটাসিয়াম ন্ইাট্রেট (৫৮০ গ্রাম)
ম্যাগানেসিয়াম সালফেট (৫১০ গ্রাম)
ম্যাঙ্গানিজ সালফেট (৬.১০ গ্রাম)
বরিক এসিড (১.৮০ গ্রাম)
কপার সালফেট (০.৪০ গ্রাম)
অ্যামনিয়াম মলিবডেট (০.৩৮ গ্রাম)
জিংক সালফেট (০.৪৪ গ্রাম)
(উপরে উল্লেখিত রাসায়নিক দ্রব্য গুলিকে ১০ লিটার পানিতে দ্রবীভুত করে Stock Solution B তৈরী করতে হবে)
ভার্টিক্যাল হাইড্রোপনিক্স এর অর্থনৈতিক হিসাব
প্লাষ্টিকের ৬ ফুট লম্বা ও ৫ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট পাইপে মাত্র ২০ লিটার পানিতে ৩০ টাকার রাসায়নিক দ্রবন ব্যবহার করতে হয়। প্রতি পাইপে ৬টি শসা/স্ট্রবেরী/লেটুস/অন্যান্য সবজি গাছ উৎপাদন করা যাবে। প্রতি পাইপে ৫০ টাকা খরচ করে ১৮০ টাকার ফসল উৎপাদন করা যাবে।
চিত্র: ভার্টিক্যাল হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে হারভেস্ট উপযোগী সবজি।
হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
১. যেহেতু হাইড্রোপনিক একটি আধুনিক চাষ পদ্ধতি তাই দ্রবণ প্রস্তুতি, দ্রবনের অ¤øত্ব, ক্ষারত্ব, EC, বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের অভাব জনিত লক্ষণসমূহ সনাক্ত করণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে দক্ষতা প্রয়োজন।
২. এ পদ্ধতির চাষে প্রাথমিক খরচ কিছুটা বেশী হয়ে থাকে।
৩. সব ধরনের ফসল (বিশেষ করে গাছ) এ পদ্ধতিতে চাষ করা যায়না।