প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিবিধ কারণে ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। আবার অনেক খামারির ঘাস চাষের জমি নেই এবং কিছু খামারি আবাদি জমিতে ঘাস চাষ করতেও চান না। কিন্তু গবাদি পশুর জন্য প্রচুর পরিমাণে কাঁচা ঘাসের প্রয়োজন হয়। তাই মাটি ছাড়াই পশুখাদ্যের চাহিদা পূরণে হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতি হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট কৌশল। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, হাইড্রোপনিক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘাস উৎপাদন খুবই সম্ভাবনাময়। শুধু এই খাদ্য দিয়ে গরু, ছাগল, ভেড়া, খরগোশ, টার্কি, মুরগী ও রাজহাঁস পালন করা সম্ভব। হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতি মানেই মাটি ছাড়া শুধু পানি দিয়ে চাষাবাদ এবং এই পদ্ধতিতে ঘাস চাষে প্রতিনিয়ত পানি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। তাই হাইড্রোপনিক্স ঘাস উৎপাদনে ফগিং স্প্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজেই, অল্প খরচে এবং সয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শ্রমিক ছাড়া পানি প্রয়োগে গবাদি পশুর খাদ্য, ঘাস উৎপাদন করা সম্ভব। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ভুট্টা, গম, বার্লি, ছোলা, সয়াবিন, খেসারি, এবং মাষকলাই বীজ থেকে ঘাস উৎপন্ন করা যায়।
উপকরণ:
১. ভাল মানের গম বা ভুট্টার বীজ (সুস্থ সবল পোকামুক্ত)।
২. গ্যালভানাইজড শিটের ট্রে বা প্লাষ্টিকের ট্রে।
৩. ঠান্ডা ও ছায়া যুক্ত পরিবেশ।
৪. পাতলা সুতি কাপড়/চট/পাটের বস্তা।
৫. সয়ংক্রিয় পানি প্রয়োগে ফগিং স্প্রে সেটআপ।
ফগিং স্প্রে সেটআপ পদ্ধতি: হাইড্রোপনিক্স ঘাস উৎপাদনে ফগিং স্প্রে প্রযুক্তি সেট করতে পানির উৎস, মোটর, ফিল্টার, ০.৫ ইঞ্চি পাইপ এবং ফগার দরকার পড়ে। এর সাথে মোটর চালাতে টাইমার ব্যবহার করতে হবে তাহলে সয়ংক্রিয়ভাবে স্প্রে করা সম্ভব হবে। প্লাস্টিক বা অ্যালুমিনিয়ামের ট্রে গুলো যে ফ্রেমের ভিতরে রাখা হবে, ঐ ফ্রেমের প্রতি তাকেই ফগিং স্প্রে সেট করে নিতে হবে। ১ হর্স পাওয়ার মোটর ব্যবহার করে প্রায় ৩৫ টি ফগার চালানো যায়। আর পানির ট্যাংক যদি ৪০ থেকে ৫০ ফিট উপরে থাকে তাহলে সমপরিমান ফগার চালাতে মোটর না হলেও চলবে।
চাষের উপযুক্ত স্থান: ঘরের ছাদ, ঘরের ভেতরের যেকোন জায়গায়, বারান্দায়, নেটহাউস, পলি হাউস, এমনকি খোলা জায়গাতেও এই ঘাস উৎপাদন করা যায় তবে ছায়াযুক্ত পরিবেশ হতে হবে।
চাষ পদ্ধতিঃ
১. প্রথমে ভুট্টার বীজকে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর পানি ঝরিয়ে ভেজা চটের বস্তা অথবা কালো সুতি কাপড়ের ভেতরে ২৪ ঘণ্টা অন্ধকার স্থানে রাখতে হবে।
২. এরপরে এক পাশ ছিদ্রযুক্ত ট্রের ভেতরে পাতলা করে বীজগুলো বিছিয়ে কালো কাপড় দিয়ে দুই দিন ঢেকে রাখতে হবে। এই দুই দিন খেয়াল রাখতে হবে যেন বাইরের আলো-বাতাস না লাগে এবং কাপড়টি সারাক্ষণ ভেজা থাকে।
৩. তৃতীয় দিন কাপড় সরিয়ে আধাঘণ্টা পরপর পানি স্প্রে করতে হবে এবং চারার দৈর্ঘ্য ১-১.৫ ইঞ্চি হলে ৩-৪ ঘণ্টা পর পর পানি স্প্রে করতে হবে। ফগিং স্প্রে এর মাধ্যমে শ্রমিক ছাড়া এটি খুব সহজেই করা সম্ভব। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ট্রেতে পনি না জমে। ট্রে একদিকে সামান্য ঢালু করে শেষ প্রান্তে একটি ছিদ্র করে দিতে হবে।
৪. তারপর শেডের নিচে সুবিধামতো একটি ফ্রেমে ট্রে গুলিকে সাজিয়ে রাখতে হবে। এবং সয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পানি স্প্রে করার জন্য ফ্রেমের সাথেই ফগিং স্প্রে পদ্ধতি সেট করে নিতে হবে। ঠিকঠাক পানি স্প্রে করলে সাত থেকে নয় দিনের মধ্যে ৬-৯ ইঞ্চি হবে। এক কেজি বীজ থেকে ৯ দিন পরে ৭ থেকে ৮ কেজি ঘাস পাওয়া যায়।
৫. তাক বানিয়ে ট্রে সাজিয়ে নিলে অবশ্যই প্রত্যেকটি তাকে ট্রে সাজানোর মাঝখানে হিসাব করে দিনের ব্যবধান রাখতে হবে। তাহলে ঘাস পাওয়ার জন্য আর সাত দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে না। একটি তাক শেষ হতেই আরেকটি খাওয়ানোর উপযুক্ত হবে। যেমন : সাতটি তাক হলে এক দিনের ব্যবধানে ট্রে সাজাতে হবে। তাহলে সাত দিন পর দৈনিক একটি তাক থেকে ঘাস সংগ্রহ করা যাবে।
হাইড্রোপনিক ঘাসের উপকারিতা
# পাঁচ বিঘা জমিতে যে পরিমাণ ঘাস উৎপাদিত হয়, মাত্র ৩০০ বর্গফুটের একটি টিনশেডের ঘরে সেই পরিমাণ হাইড্রোপনিক্স খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব।
# ১০ থেকে ১৫ ভাগ দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। দুধের ফ্যাট ও এসএনএফ শতকরা ০.৩ থেকে ০.৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
# এ ঘাস শতকরা ৯০ ভাগ হজমযোগ্য এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নেই।
# এ ঘাসে দানাদারের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি পরিমানে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি বিদ্যামান।
# গর্ভধারণের হার বৃদ্ধি পায় কারণ এ ঘাসে ভিটামিন ই, সেলিনিয়াম, ভিটামিন এ পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান।
# এ ঘাস আঁশ, উদ্ভিজ আমিষ, নানাবিধ ভিটামিন ও খনিজ লবণের উৎস।
# এতে প্রোটিনের পরিমান ৩১.৯৯%, আর সাধারণ ঘাসে প্রোটিন থাকে ১১.৫%।
# এনার্জি ৪৭২৭ কিলোক্যালরি/কেজি আর সাধারণ ঘাসে ২৬০০ কিলো ক্যালরি/কেজি, তাই সাধারণ ঘাস দিনে তিন বার লাগে আর এটা দুই বার দিলে হবে।
# সাধারণত ৮০ লিটার পানি খরচ করে যে পরিমাণ ঘাস পাওয়া যায়, সে পরিমান হাইড্রোপনিক্স ঘাস ফলাতে মাত্র ৩ লিটার পানি লাগে।
# ৭-৯ দিনে এই ঘাস যে পরিমাণ বাড়ে, সে পরিমান বাড়তে সাধারন ঘাসের ৩৭-৪০ দিন লাগে।
# এ ঘাস সারা বছরই চাষ করা যায় এবং মাটিবাহিত কোন রোগ হবে না।
# এটা সহজে পশুকে পরিবেশন করা যায়, কাটা কাটির দরকার হয় না
# এর মাধ্যমে খামারের শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমানো যায়।
সতর্কতা
হাইড্রোপনিক ঘাসে আমিষের পরিমান অনেক বেশি থাকে কিন্তু ফাইবার (আঁশ) কম থাকে। এ কারণে ননরুমিনেন্ট প্রাণী যেমন: খরগোশ, গিনিপিগ, টার্কি, মুরগীর জন্য স্বাস্থ্যকর হলেও রুমিনেন্ট পশু যেমন: গরু ও ছাগলের জন্য হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া ছত্রাকের (মোল্ড) সমস্যাও হতে পারে। ছত্রাকের সমস্যা বীজের মাধ্যমেই ছড়ায়, তাই সুস্থ, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন বীজ সংগ্রহ করতে হবে। এরপরও ঝুঁকিমুক্ত থাকার জন্য বীজগুলো ভালো করে ধোয়ার পর জীবাণুমুক্ত করতে হবে।